Intermittent Fasting বা সবিরাম উপবাস কি ? এটা কি অনাহার (Starvation) ?
না। অবশ্যই উপবাস এক বিশেষ কারনে অনাহার থেকে পৃথক: আর তা হলো "নিয়ন্ত্রণ" (Control)।
অনাহার অর্থ আপনি কখন খাবেন তা আপনি জানেন না। এটি ইচ্ছাকৃত বা নিয়ন্ত্রিত নয়।
অন্যদিকে উপবাস আধ্যাত্মিক, স্বাস্থ্য বা অন্য কোনও কারণে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় করা হয়। যেমন আমরা রমজান মাসের রোজা রাখি। এটি নিয়ন্ত্রিত ।
খাবার আপনার সামনেই আছে - আপনি কেবল এটি না খাওয়ার জন্য বেছে নিচ্ছেন; এটিই উপবাস। এটি যে কোনও সময়, কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের জন্যও হতে পারে। এমনকি চিকিতসকের তদারকিতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। আপনি যে কোনও কারণেই বা কোনও কারণ ছাড়াই উপোস শুরু করতে বা বন্ধ করতে পারেন। উপবাসের কোনও নির্দিষ্ট সময়কাল নেই।
উপবাসটি আমাদের জানা সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ডায়েটারি হস্তক্ষেপ হতে পারে। খাদ্য গ্রহন কেবল ডায়াটের অংশ নয়, খাদ্য বিরতিও ডায়াটের অংশ।
‘Break fast’ শব্দটি বিবেচনা করুন, যার মানে breaking fast অর্থ উপবাস ভাঙ্গা। যদিও একে সকালের নাস্তা হিসাবে ভেবেই আমরা ভুল করেছি। এটি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের খাবারের বিরতি। সেটা যেকোনো সময় হতে পারে। তবে উপবাস ভাঙার জন্য আমাদের অবশ্যই উপবাস থাকতে হবে। সুতরাং, উপবাস কোনো নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক শাস্তি নয়, বরং এটা দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ।
উপবাস এবং খাদ্য গ্রহন ভারসাম্যময় হতে হবে। তাহলে না আপনার ওজন বাড়বে , না আপনার ওজন কমবে।
তবে যদি আপনি ওজন হ্রাসের দিকে ভারসাম্যটি পেতে চান, অর্থাৎ আপনার ওজন কমাতে চান, তবে আপনি আপনার দিনের উপবাসের অংশটি বাড়িয়ে তুলতে পারেন। এটাই ওজন কমানোর মূলনীতি। এবং সহজ পদ্ধতি।
তাহলে সবিরাম উপবাসের লাভগুলো কি কিঃ
উপবাসের মাধ্যমে আপনার ওজন অবশ্যই কমে যাবে। গ্যারান্টি। কিন্তু ওজন কমানো উপবাসের উপকারিতার শুরু মাত্র। অন্যান্য উপকারিতার মধ্যেঃ
১। আপনি মেদ কমাতে পারবেন সহজেই।
২। আপনার পেটের চর্বি পোড়াতে পারবেন।
৩। আপনার ইন্সুলিন কমে যাবে এবং রক্তের গ্লুকোজও কমে যাবে।
৪। আপনার HbA1C কমে যাবে।
৫। আপনার মানসিক শক্তি, তীক্ষতা ও মনোযোগ বেড়ে যাবে।
৬। আপনি প্রচুর শক্তি পাবেন।
৭। আপনার বেড়ে উঠার হরমোন ( Growth Hormone) এর পরিমান বেড়ে যাবে যা আপনার কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
৮। আপনার শরীরে যে সারাক্ষন জ্বালা পোড়া (Inflammation) করে, তা কমে যাবে, এমন কি নির্মুল হয়ে যাবে।
৯। আপনার কর্মদক্ষতা বেড়ে যাবে।
১০। অটোফেজির (Autophagy) মাধ্যমে আপনার শরীরের কোষগুলোকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করবে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই উপবাসের সময়কালকে ‘পরিষ্কারকরন Cleanses)’, ‘‘বিষাক্ত বিদুরীকরন (Detoxification)’বা‘ শোধনা ( Purification)’ যা-ই বলা হত না কেন,সবগুলোর ধারণা কিন্তু একই ছিল। পর্যায়ক্রমে খাবার থেকে বিরত থাকা শরীরের বিষাক্ত পদার্থকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে এবং শরীরকে চাঙ্গা করে।
উপবাস শরীরকে শক্তির সঞ্চিত উৎস - রক্তের শর্করা এবং দেহের ফ্যাট বা চর্বি ব্যবহার করতে দেয় ঃ
আমরা খাওয়ার পরে কি ঘটে:
যখন আমরা খাই, তখন আমরা যা ব্যবহার করতে পারি তার চেয়ে বেশি খাদ্য-শক্তি (ক্যালোরি) খাই। এতে ইনসুলিন হরমোন বেড়ে যায়, যা এই অতিরিক্ত শক্তিকে আমাদের দেহের লিভারে গ্লুকোজ আকারে (গ্লাইকোজেন) বা শরীরের ফ্যাট হিসাবে সঞ্চয় করে।
চিনি: স্বতন্ত্র গ্লুকোজ (চিনি) ইউনিটগুলি দীর্ঘ শিকলের সাথে যুক্ত হয়ে গ্লাইকোজেন গঠন করে লিভারে জমা হয়। এটি একটি শক্তি। এই শক্তি স্টোরটি সহজেই ব্যবহারযোগ্য, তবে এর সঞ্চয় ক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
দেহের ফ্যাট: অতিরিক্ত ডায়েটরি গ্লুকোজ এবং প্রোটিনকে লিভারে সঞ্চয়ের জন্য চর্বিতে পরিণত করা হয়, যাকে ডি-নভো লাইপোজেনেসিস বা আক্ষরিক অর্থে, "নতুন ফ্যাট তৈরি করা" বলা হয়। ইন্সুলিন এই কাজটি করে। শক্তি সঞ্চয়-এর এই ব্যাপারটি আরও জটিল, তবে সঞ্চয়ের সক্ষমতার কার্যত কোনও সীমা নেই। যত খুশী তত গ্লুকোজ চর্বি আকারে লিভারে জমা করা যায়।
এই দুটি খাদ্যশক্তির স্টোরেজ সিস্টেম একে অপরের পরিপূরক। গ্লাইকোজেন সহজেই ব্যবহারযোগ্য তবে স্টোরেজ স্পেস সীমাবদ্ধ রয়েছে। বডি ফ্যাট ব্যবহার করা আরও কঠিন তবে সীমাহীন স্টোরেজ স্পেস রয়েছে।
যখন আমরা না খাই অর্থাৎ উপোস থাকি তখন কী ঘটে:
শক্তি সঞ্চয় করার প্রক্রিয়া থেমে যায় যখন আমরা না খাই বা উপবাস করি। ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাস পায় এবং শরীর স্টোরেজ এনার্জি, গ্লাইকোজেন এবং দেহের ফ্যাট জ্বালানো শুরু করে।
গ্লাইকোজেন প্রথমে ব্যবহৃত হয় কারণ এটি সর্বাধিক সহজলভ্য (easily accessible)। এটি পৃথক গ্লুকোজ অণুতে বিভক্ত হয়ে রক্ত প্রবাহে চলে যায় যা অন্যান্য অঙ্গ এবং টিস্যুতে শক্তি বিতরণ করে। এজন্য রমজান মাসে যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা রোজা রাখলেও রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়, তাই রোজা রাখতে ভয় পান। ভয় পাবেন না, কারন এই গ্লুকোজ আপনার সঞ্চিত গ্লুকোজ, এটা ভাঙ্গাই চাই। যদি আপনি রমজানে শর্করা (ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, ব্রেড, ওট) না খান, তবে একসময় সঞ্চিত গ্লুকোজ কমে যাবে। একবার গ্লাইকোজেন স্টোরগুলি হ্রাস হয়ে গেলে, শক্তির জন্য শরীর শরীরে জমানো মেদ বা চর্বি ভেঙে ফেলা শুরু করে (Lipogenolysis)। রোজা তাই ডায়াবেটিস রুগীর জন্য একটা মোক্ষম সুযোগ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার ও অতিরক্ত ওজন কমানোর।
কম কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা খাদ্য ( Low carbohydrate diet) কম গ্লাইকোজেন জমা হতে সাহায্য করে, যা উপবাস অবস্থায় কম গ্লুকোজ ভাংতে সাহায্য করে। এমনকি এটি উপবাস অবস্থায় প্রাথমিকভাবে শরীরের মেদ পোড়াতেও সাহায্য করে।
প্রকৃতপক্ষে, হয় আমরা খাদ্য শক্তি সঞ্চয় করছি, অথবা আমরা সঞ্চয় শক্তি জ্বালিয়ে দিচ্ছি। এটি একটি প্রাকৃতিক চক্র। খাওয়ানো এবং উপবাস। উপবাস এবং খাওয়ানো। একটি যেন অন্যজনকে স্বাভাবিকভাবে অনুসরণ করে যেমন রাত দিন এবং দিন রাত্রিকে অনুসরণ করে।
যদি খাওয়ানো এবং উপবাস ভারসাম্যপূর্ণ হয় তবে নেট ওজন পরিবর্তন হবে না। আপনার ওজন বাড়বে না এবং ওজন হারাবেনও না। অনেক আগের কথা চিন্তা করুন, যখন গ্রামের কৃষক কেবল দুইবেলাই খেত, সকাল ১০টায় আর রাতে ৬টায় বা সাতটায়। শহরের মানুষও তিন বেলার বেশি খেতো না। মাঝে খুব বেশি হলে পানি পান করা। আমি ৬০-৭০ দশকের কথা বলছি, যখনো Obesity বা ওজনবৃদ্ধির ভয়াবহতা আমরা দেখি নাই। তখন না ছিলো একটু পর পর খাওয়ার অভ্যাস, না ছিল তথাকথিত snacks।
আমাদের শরীরে একই সাথে খাদ্যগ্রহন ( যখন ইন্সুলিন বেড়ে যায়) ও উপবাস ( যখন ইন্সুলিন কমে যায়) দুই প্রক্রিয়া একসাথে চলতে পারে না।
যদি খাওয়ানো প্রাধান্য পায় তবে আমাদের ওজন বাড়বে কারন ইনসুলিন বেড়ে যাবে। যদি আমরা বিছানা থেকে উঠার পর থেকেই খাওয়া শুরু করি এবং ঘুমাতে না যাওয়া পর্যন্ত থামি না, আমরা আমাদের সমস্ত সময় খাওয়ানো অবস্থায় কাটিয়ে দেই, তবে সময়ের সাথে সাথে আমরা আমাদের ওজন বাড়িয়ে দেব।কারণ আমাদের দেহ এতে পর্যাপ্ত সময় পায় না , যে সে সঞ্চিত খাদ্য শক্তি জ্বালিয়ে দিতে পারে। বর্তমানে আমরা দুই খাবারের মাঝে খুব কম বিরতি দেই, কেননা ডাক্তার বলেছে, বারবার খেলে ক্ষুধা কম লাগবে, একবারে বেশী খেতে মন চাইবে না, এতে শরীরের ওজন বাড়বে না। ব্যাপারটি খুবই হাস্যজনক। বারবার খেলে আমাদের সঞ্চিত খাদ্য জ্বলবে কিভাবে? সঞ্চিত চর্বি গলবে কিভাবে?
যদি আমরা ওজন হ্রাস করতে চাই, তবে আমাদের সঞ্চিত খাদ্য শক্তি জ্বালানোর সময় বাড়াতে হবে, অর্থাৎ না খাওয়ার সময় বাড়াতে হবে। । এটাই অন্তর্বর্তী উপবাস বা Intermittent Fasting। এটি মূলত শরীরকে তার সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। সত্যি বলতে কি, আমরা পরে ব্যবহার করবো বলেই এটি সঞ্চয় করে রেখেছি। গুদামের বা ফ্রিজের খাদ্য তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন খাদ্যের সংকট হয়। তাই সবিরাম উপবাস বা Intermittent Fasting সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। উপবাস বা রোজা রাখতে তাই ভয় পাবার কিছু নাই। বরং এটা আপনার জন্য একটা মহাওষুধ।
বেঞ্জামিন বলেছিলেন ঃ
যারা ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত হতে চান, অতিরিক্ত ওজন কমাতে চান, পেটের মেদ দূর করতে চান, ইন্সুলিনের খোঁচা থেকে চিরস্থায়ীভাবে বাঁচতে চান, সত্যি করে বলছি, সাহস করে উপবাস থাকা শুরু করন এবং এর ম্যাজিক দেখুন।
বিস্তারিত জানতে আমার ব্লগের ভিডিও ও লেখাগুলো পড়ুন। প্রশ্ন থাকলে ইনবক্সে লিখুন।
No comments:
Post a Comment